***সিলেটী নাগরী এবং বাংলার ইসলামী সাহিত্যের এক অনন্য ও অজানা অধ্যায়***      

বাংলায় সুলতানি আমল শুরু হওয়ার পর অপ্রতিরোধ্য গতিতে বাংলার ইসলামীকরণ চলতে থাকে। এই ইসলামীকরণ বড় ধরণের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয় চৈতন্য মহাপ্রভুর উত্থানের পর। ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে চৈতন্য মহাপ্রভু ওড়িশা’র জগন্নাথ হতে বাংলায় ভক্তিবাদের আমদানি করেন। এই ভক্তিবাদের প্রথম উত্থান হয় অষ্টম সতকে দক্ষিণ ভারতে (কেরালা ও তামিল নাড়ুতে)। আস্তে আস্তে এই আন্দোলন সমগ্র উত্তর ভারতে ছড়িয়ে পড়ে, বিশেষতঃ মুসলিমদের আগমনের পর। উত্তর প্রদেশের তুলসিদাস এই আন্দোলনকে অনেকখানি বেগবান করে। চৈতন্য মহাপ্রভুর কল্যাণে কৃষ্ণকেন্দ্রিক সগুণ ভক্তিবাদ বাংলার আনাচে কানাচে ছড়িয়ে পড়ে। নতুন নতুন যারা মুসলিম হচ্ছিল তারা কৃষ্ণভজনে আকৃষ্ট হয়ে পূর্বের ধর্মে ফেরত যাচ্ছিল। এমনকি লোকশ্রুতিতে আছে যে, সেই সময়কার সুলতানও চৈতন্য মহাপ্রভুকে বিভিন্ন সাহায্য করেছিলেন তার ভক্তিবাদ প্রচারে। ভক্তিবাদের ফলে হিন্দু সমাজের জাত-পাতের শৃঙ্খল বেশ শিথিল হয়ে গিয়েছিল। ভক্তি সাধকদের দ্বারা দেবনাগরী ও বাংলা লিপিতে বহু ভক্তি সাহিত্য রচিত হতে থাকল, যা ইসলামীকরণকে প্রতিহত করার ক্ষেত্রে বেশ ভালো ভুমিকা পালন করছিল।

 এই ভক্তিবাদ যখন সব জায়গায় ছেয়ে যাচ্ছিল তখন পূর্ব বাংলার শ্রীহট্টে (সিলেট) উত্থান ঘটল একটি লিপির। এই লিপির মুখ্য উদ্দেশ্যই ছিল মুসলিমদের সাহিত্য চর্চাকে একটি সুসংহত রূপ দেয়া। একে একটি নিরব আন্দোলন বলা যায়। ধর্মভীরু মুসলিমদের অসংখ্য পুঁথি সাহিত্য লিখা হতে থাকে এই নাগরী লিপিতে। এই লিপির সাথে মুসলিম ও ইসলামের পরিচয় এমনভাবে জড়িয়ে যায় যে একে মানুষ মুসলমানি নাগরী বা জালালাবাদি নাগরী হিসেবে ডাকা শুরু করে। কারণ, এই লিপি মুসলিমরাই শিখত এবং হিন্দুরা এটি শিখত না। শত শত বছর ধরে বাংলার পূর্বাঞ্চল ও আসামে এই লিপিতেই মুসলিমরা সাহিত্য চর্চা করত এবং চিঠিপত্র লিখত।

এর উৎপত্তি নিয়ে বহু মত আছে। তবে প্রখ্যাত ইতিহাসবিদ আহমাদ হাসান দানীর মতে – ষোড়শ শতকে বহু পাঠান বিহার এবং উত্তর প্রদেশ হতে বাংলার দিকে চলে আসে। প্রথম পানিপথের যুদ্ধে পাঠান লোদীদের পতনের পর বহু পাঠান মুঘলদের থেকে পালিয়ে যাবার জন্য চট্টগ্রাম এবং সিলেটে এসে বসবাস করে। আজও বিহার এবং উত্তর প্রদেশে বহু পাঠান বাস করে। তারাই এই সিলেট অঞ্চলে এসে এই লিপির প্রচলন করে। এর সপক্ষে বলা যায় যে – বিহারে প্রচলিত কাইথি লিপির সাথে সিলেটের নাগরী লিপির বহু মিল রয়েছে। এই মতটিই সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধ এবং যুক্তিযুক্ত মত। এছাড়া, ষোড়শ শতকের শেষ এবং সপ্তদশ শতকের প্রথম দশকের বাংলার পাঠান সালতানাতগুলোর মুদ্রায় সিলেটি নাগরীর ব্যবহার দেখা যায়।

এই লিপিতে রচনা হতে থাকে শত শত পুঁথি ও দোভাষী মুসলিম সাহিত্য। গুরুত্বের দিক থেকে একে ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলের উর্দু আখ্যা দেয়া যেতে পারে। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যেখানে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মুসলিমরা নাস্তালিক (আরবি-ফার্সি লিপি) লিপি ব্যাবহার করে তাদের ভাষা লিখার জন্য, সেখানে নাগরী লিপির উৎপত্তি হয়েছে মুলতঃ কাইথি, দেবনাগরী এবং বাংলা লিপির সমন্বয়ে। এটাকে ভারতবর্ষের এমন একমাত্র ইসলামী ভাষা বলা যায় যেটা এই অঞ্চলে উদ্ভূত লিপিই ব্যাবহার করেছে তাদের নিজস্ব লিপির প্রণয়নে। কেন এমনটা হল তা বের করতে অবশ্যই বিস্তর গবেষণা হওয়া উচিত।

এ লিপিতে মোট বর্ণ সংখ্যা ছিল ৩৩টি। এর মধ্যে স্বরবর্ণ ৫টি, ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি এবং ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন ১টি। স্বরবর্ণ ৫টি হচ্ছে- আ, ই, উ, এ, ও। ব্যঞ্জনবর্ণ ২৭টি হচ্ছে- ক, খ, গ, ঘ, চ, ছ, জ, ঝ, ট, ঠ, ড, ঢ, ত, থ, দ, ধ, ন, প, ফ, ব, ভ, ম, র, ল, শ, হ, ড় এবং একমাত্র ধ্বনি-নির্দেশক চিহ্ন হচ্ছে- ং।   

রাজকার্যের সাথে এই লিপি প্রচলনের তেমন কোনো সম্পর্ক ছিল না। নাগরী লিপিতে রচিত গ্রন্থের অনেকগুলো নামাজ, রোজা, হজ্জ, ইসলামি জীবনব্যবস্থা, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি বিষয়ের উপরে রচিত। কিছু গ্রন্থ ইসলামি মারফত বিষয়ক। কিছু গ্রন্থের পুথিতে পীর ও আউলিয়াদের জীবনী লিখিত। আবার কিছু কিছু গ্রন্থের পুথিতে রয়েছে প্রেম-উপাখ্যান। এই সকল পুথি জনসাধারণের শোক ও দুঃখে সান্ত্বনার বাণী এবং বিশ্রামে আনন্দ প্রদান করত। সিলেটি নাগরীতে লিখিত এযাবৎ প্রাপ্ত সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ হচ্ছে সাধক কবি গোলাম হুছনের তালিব হুছন (১৫৪৯)। পরে ফাজিল নাসির মোহাম্মদের রাগনামা (১৭২৭), সৈয়দ শাহ নূরের (১৭৩০-১৮৫৪) নূর নছিহত (১৮১৯), রাগনূর, সাতকন্যার বাখান, শাহ হুছন আলমের (১৭৫০-১৮৫০) ভেদসার, শীতালাং শাহের (মৃত্যু. ১৮০০) মুশকিল তরান, হাসর তরান, কেয়ামতনামা, নছিম আলীর (১৮১৩-১৯২০) হরুফুল খাছলাত (১৮৭৫), মুন্সী মোহাম্মদ সাদেক আলীর হালতুন্নবী (১৮৫৫), মহববতনামা, হাসর মিছিল, রদ্দেকুফুর ইত্যাতি গ্রন্থ রচনা করেন। আবদুল করিম রচিত কড়িনামা, ছদছী মছলা, সোনাভানের পুঁথি এককালে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এযাবৎ প্রাপ্ত তথ্যে ষাটজন লেখকের মুদ্রিত ও পান্ডুলিপি মিলিয়ে ১৫০খানা গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া গেছে। লেখকের নামবিহীন জনপ্রিয় পুথিগুলির মধ্যে হরিণনামা, হুশিয়ারনামা, সফাতুন্নবী, আবু সামা, নূর নাজাত, পেঁচার গল্প ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এই অমূল্য রচনাগুলোর মধ্যে হালতুন্নবী এখনো খুবই জনপ্রিয়।

যাই হোক বিংশ শতাব্দী হতে এই লিপি আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে থাকে। সরকার আসে যায় কিন্তু নাগরীর প্রতি তাদের বিমাতাসুলভ আচরণের কোন পরিবর্তন হয়নি। এই লিপিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তেমন কোন উদ্যোগ নেয়নি। খোলা হয়নি আলাদা কোন স্কুল অথবা ছাপানো হয়নি কোন শিশু পাঠ্যবই। যেখানে, বাংলাদেশে বসবাসরত সমস্ত নৃগোষ্ঠীর মাতৃভাষা ও মাতৃলিপিতে বই ছাপানোর জন্য কথা চলছে সেখানে নাগরী লিপি নিয়ে কারও মাথাব্যথা কেন নেই?

এর কারণ কি এটাই যে এই লিপিটি শুধুমাত্র মুসলিমরা ব্যাবহার করত বলে এবং এই লিপিতে শুধুমাত্র ইসলামী সাহিত্য রচনা হত বলে? আমরা কি তাহলে ভাবব যে, নাস্তালিকের পরিবর্তে কাইথি এবং দেবনাগরী ব্যাবহার সত্ত্বেও এই অমূল্য লিপি বাম-রাম সেকুলারদের চোখে জাতে উঠার যোগ্যতা রাখে না? অবশ্য আমাদেরও এখানে দোষ কম নয়। আমরা অন্য ভাষা ও লিপির প্রতি যে মুগ্ধতা প্রকাশ করি সেই মুগ্ধতা কি নিজেদের ভাষা ও লিপির প্রতি রাখি? দুই একটা উর্দু-ফার্সি শের মেরে দিয়ে যেমন গর্ব প্রকাশ করি আমরা, হালতুন্নবী নিয়ে কি সেই গর্ব আমাদের কাজ করবে?   

বিংশ শতাব্দীতে প্রভুপাদের দ্বারা চৈতন্য আদর্শের পুনর্জীবন ঘটেছে, গড়ে উঠেছে ইস্কন। সনাতন ধর্মীরা তো তাদের সংস্কৃতি কখনোই ভুলে না। যদি চৈতন্য মহাপ্রভুর আদর্শ পুনর্জীবিত হতে পারে, তাহলে আমাদের মুসলমানি নাগরীর পুনরুত্থান কেন নয়?

ভাষার মাসে এই প্রশ্ন রেখে গেলাম।                                                              

#ইসলামেরইতিহাস #বাংলাভাষায়ইতিহাস